রোহিঙ্গা কারা এবং তাদের প্রকৃত ইতিহাস কি

রোহিঙ্গাদের পরিচয় এবং তাদের ইতিহাস জানতে চাননি এমন কোন বাঙালি নেই। কারণ বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদেরকে এক হিসেবে সারা বিশ্বের সবচাইতে ভাগ্যহত জনগোষ্ঠী বলা যায়। এককালে তাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকলেও বর্তমানে তারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। বিগত শত শত বছর ধরেই মানবেতর জীবন যাপন এবং নির্যাতিত হয়ে আসছে এই জনগোষ্ঠীটি।

রোহিঙ্গা কারা এবং তাদের ইতিহাস জানলে যে কারো হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে।

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এবং পরিচয়

আরাকান এই উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্য গড়ে ওঠা মুসলিম মুসলিম বসতি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা মূলত সেই আরাকানের বংশধর এবং মুসলমান জনগোষ্ঠী। আপনারা নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্য পড়ার সময় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল এর নাম শুনেছেন। তিনি সেই আরাকান রাজ্যসভার কবি ছিলেন। তার রচনায় রয়েছে বিখ্যাত পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলক ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ।

আর এখানে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন প্রায় ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে স্থায়ী হয়। সে সময় মুসলিমরা আরও রাজ্য এবং অধিপত্য বিস্তার করে। রোহিঙ্গা কারা এবং তাদের সম্পর্কে জানতে গেলে এ সকল ইতিহাস গুলো জানা জরুরী।

১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানের অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায় একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে। যার পর থেকেই অবসান ঘটে মুসলিম শাসনের।

মুসলিম শাসনের অবসান এর পর রাজা থান্দথুধম্মা রাজ্যে আশ্রয় হিসেবে থাকা মোগল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে তার পরিবারসহ হ-ত্যা করে। তারপর থেকে অমানবিক অত্যাচার এবং দমনে অভিযান শুরু হয় মুসলমানদের উপর। এই দুর্বিষহ অবস্থা চলে পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে।

এরপর রাজা বোধাও পায়ার আরাকান রাজ্য আধিপত্য বিস্তার করেন। এই ঘটনাটি ১৭৮২ সালের। তিনি ছিলেন মুসলমানদের বিরোধী। ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের ঢালাওভাবে নিধন শুরু করতে তিনি। শুরু হতে থাকে আরেক অত্যাচার।

রোহিঙ্গাদের পরিচয় জানতে আরো কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। ১৮২৮ সালে বর্তমান যেটি মায়ানমার নামে পরিচিত সেটি ইংরেজদের শাসনের অধীনে চলে যায়। বার্মা বা মায়ানমার নিজেদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন লাভ করে ১৯৩৭ সালে। পরবর্তীতে বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেশ বড়সড়জোড়েই আকার ধারণ করে এবং ৩০ লাখ মুসলিমকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে মে-রে ফেলা হয়। শত শত বছর ধরে নির্যাতিত মুসলমানরা আস্তে আস্তে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।

আমরা বর্তমানে যেটিকে রাখাইস নামে চিনি সেটির নামকরণ করা হয় ১৯৮১ সালে। অর্থাৎ আরাকান রাজ্যের নামই পরবর্তীতে রাখাইন নামে পরিচিত লাভ করে। রোহিঙ্গা কারা এটি বুঝতে আরো কিছু তথ্য জানুন। রাখাইন নামকরণের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইতিহাস বিকৃতির এক ঘৃণ্যতম চক্রান্ত।

রোহিঙ্গাদের পরিচয়

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়। বিগত শত শত বছর ধরে তারা মায়ানমারে বসবাস করলেও সে দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিক। এমনকি রোহিঙ্গাদের পরিচয় মুছে দিতে হাজার ১৯৮২ সালে বার্মা বা মায়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। এবং নিজ দেশে তাদেরকে বহিরাগত বসবাসকারী হিসেবে উল্লেখ করে। যার কারণে রোহিঙ্গারা হারিয়ে ফেলে ভোটাধিকার সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার।

এমনকি নিজ দেশেরই পরগাছার মতো নিপীড়িত হতে থাকে এই জনগোষ্ঠী। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মায়ানমারের একটি প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশেও যেতে পারবেনা এরকমও বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এক সময় যে অঞ্চলে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ সে অঞ্চলে হয়ে যায় সংখ্যা লঘু। শত শত যুগ ধরে ভাগ্যে নির্মম পরিহাসের শিকার এই জনগোষ্ঠী ভাগ্যে নেমে আসে আস্তে আস্তে আরো বেশি দূর্দশা।

এখানে আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পরিচয় এবং অস্তিত্বকে অস্বীকার করে মায়ানমার সরকার তাদেরকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বলেও অভিহিত করেছে। কিন্তু আরাকান জেটি বর্তমান রাখাইন রাজ্য সেখানে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বিগত কয়েকশত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এরকম একটি নাগরিক গোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নিয়েই বরং তারা থেমে থাকে না তাদেরকে উচ্ছেদ করেছে এবং অনেককেই নৃশংসভাবে মে-রে-ছে।

তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল টুকু। এমনকি উপার্জিত সম্পদ, নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, কোন কিছুই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। রোহিঙ্গা পরিচয়ে বেঁচে থাকার জন্য একদিক থেকে আরেক থেকে ছুটছে একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

রোহিঙ্গা কারা

অনেকেই দেখা যায় ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের নানারকম আখ্যা দিয়ে তাদেরকে কটাক্ষ করতে। তাদের উদ্দেশ্য করে এটুকু বলতে চাই আপনার পরিবারকে যদি এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হতো তাহলে আপনি কি করতেন?

প্রতিটি রোহিঙ্গায় তাদের চোখের সামনে পরিবারের কাউকে না কাউকে নিপীড়িত এবং অত্যাচারিত হতে দেখেছে। শরীরের উপর কা-মা-ন রেখে বের করে ফেলা হয়েছে মাথার ম-গজ। প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে ফুটবলের মত লাথি দিয়ে মে-রে ফেলা হয়েছে।

বার্মায় রোহিঙ্গাদের সাথে এই ধরনের অত্যাচার চলে আসছে বিগত কয়েকশত বছর ধরে। রোহিঙ্গা কারা এবং তাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করার আগে এই ইতিহাস গুলো নিয়ে একটিবার ভাবুন। তাহলেই তাদের ভেতরের কষ্ট এবং চাপা দুঃখ গুলো অনুভব করতে পারবেন।

সেই সাথে আরাকান থেকে কিভাবে রাখাইনে পরিণত হয়েছে সেটি সম্পর্কেও জানা উচিত। তাহলে রোহিঙ্গাদের পরিচয় সম্পর্কে আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন।

অনেকেই আবার বলতে শোনা যায় তারা মুসলিম বলে নির্যাতিত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক বক্তব্য। বাংলাদেশেও আশ্রিত অবস্থায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের পরিচয় জানার চেয়ে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Comment