বিজ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা হচ্ছে কেমিস্ট্রি (Chemistry) বা রসায়ন। আজকে আমি দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহার গুলো সম্পর্কে তুলে ধরব। মানুষ তাদের জীবনকে উন্নত এবং সহজ করার জন্য নানা ভাবে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আবিষ্কৃত হচ্ছে আরো নতুন নতুন বস্তু এবং পন্থা। ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ কিভাবে আমাদের জীবনের সাথে জড়িত আছে চলো সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেই।
প্রথমেই একটি উদাহরণ দেই। খাবার দ্রব্য সংগ্রহ করার জন্য আমরা সাধারণত প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করে থাকি। যেটি একটি রাসায়নিক পদার্থ। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করি নানা ধরনের সার। আবার বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না কেমিক্যাল ইকুইপমেন্ট। যদিও এর মধ্যে কিছু কিছু আছে যেগুলো পরিবেশের জন্য ভালো নয় তবুও সেগুলোর মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
রসায়ন কিভাবে আমাদের জীবনের সাথে জড়িত
১। ঘরবাড়িতে বা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার
খাবার লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড (MgCl2), ভিনেগার, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl2) ইত্যাদি আমরা নিয়মিত রান্নার কাজে ব্যবহার করে থাকে। অর্থাৎ সমুদ্র থেকে যে লবণ সংগ্রহ করা হয় সেটিও একটি রাসায়নিক উপাদান।
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের সোডিয়াম আয়ন, পটাশিয়াম আয়ন রয়েছে। যেগুলোর ঘাটতব দেখা দিলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি। আবার শরীরে কোনো কারণে যদি এই সকল পদার্থের কমতে দেখা যায় তাহলে খেতে হয় নানা ধরনের ওষুধ।
বাসা বাড়িতে কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহার করা হয় ডিটারজেন্ট বা সাবান। যেটি একটি ক্ষারীয় উপাদান। আবার ইলিশ মাছ সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহার করা হয় লবণ। সুতরাং দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহার কত গুরুত্বপূর্ণ।
২। চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহার
অসুখ হলে আমরা ওষুধ খেয়ে থাকি। সেটি হতে পারে ট্যাবলেট, সিরাপ, ইনজেকশন, স্যালাইন বা অন্য কোন মেডিসিন। তবে ধরন যাই হোক না কেন ফার্মেসি কিংবা ওষুধ শিল্পের পুরোটাই টিকে রয়েছে রসায়নের ব্যবহারের উপর। বলতে পারেন মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রেও এটির গুরুত্ব অনেক বেশি।
এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ এই সকল পদার্থ সম্পর্কে খুব একটা জানত না। আর না জানার কারণে সামান্য কোন অসুখেই কিংবা খুব ছোট কারণেই মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তো কিন্তু মারা যেত। কিন্তু বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের কল্যাণে আমরা পৃথিবীতে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল পদার্থের ব্যবহার জানতে পেরেছি। জ্বর হলে আমরা নাপা বা এ ধরনের মেডিসিন খাই। ফলে খুব সহজেই আমরা আরোগ্য লাভ করতে পারি। যেটি রসায়নেরই অবদান।
৩। খাদ্য সংরক্ষণ ও তৈরিতে
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য রয়েছে যেটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়োজন পড়ে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা সবচাইতে বেশি ব্যবহার করে থাকি ভিনেগার এসিড। ভিনেগার এসিডের রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে (CH,COOH)। আবার খাবারে বাড়তি স্বাদ, কিংবা ঘ্রাণের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আয়না, কাচ, বাথরুম ইত্যাদির দুর্গন্ধ দূর করার ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়। আবার খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ অথবা প্যাকেটজাতক খাদ্য দ্রব্য দেয় প্রিজারভেটিভ দেওয়া হয়।
৪। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে
সবাই চায় তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অনেক বেশি পরিমাণে শস্য কিংবা ফসল উৎপাদিত হোক। অনেক সময় গাছে নানা ধরনের অসুখ কিংবা পোকামাকড়, কীট পতঙ্গের আক্রমণে যথাযথ ফসল উৎপাদন হয় না। এখানেও সমাধান দিয়েছে রসায়। যেটা কিনা দৈনন্দিন জীবনে রাসায়নিক (Chemical) ব্যবহারের মধ্যে অন্যতম একটি অংশ।
আমরা বিভিন্ন ধরনের সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। যেগুলো মূলত রাসায়নিক উপাদান। বাংলাদেশে কৃষি, ধান, তুলা পাট, গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। যেখান থেকে এ সকল বিষয়ে তথ্য এবং কৃষকদের সহযোগিতা করা হয়। এমনকি মানুষের নানা রোগেরও চিকিৎসার পাশাপাশি এই সকল ফসলের রোগের নতুন নতুন ঔষধ এবং ভ্যাকসিনও আবিষ্কার করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও কৃষি এবং শিল্পের বিকাশে এই সেক্টরের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহার
উপরে আমি শুধুমাত্র কয়েকটি পয়েন্ট আলোচনা করেছি মাত্র। এছাড়াও কেমিস্ট্রির অনেক ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে রসায়নের বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুতের মাধ্যমে দেশের মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা ও পূরণ হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরনের সুখ উপাদান যেমন ডিটারজেন্ট, স্যানিটাইজার, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদি কেমিস্ট্রির অবদান। যার মাধ্যমে আমার নিজেদেরকে আরও বেশি পরিষ্কার এবং সচেতন রাখতে পারি।
বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির যেমন পেট্রোল-ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, বায়ো ফুয়েল সৌর প্যানেল, ব্যাটারি ইত্যাদিও আমরা পেয়ে থাকি এই সেক্টর হতে। অর্থাৎ যানবাহন কিংবা মানুষের চলাচলায় ব্যবহৃত সকল ডিভাইসে রয়েছে এর অবদান।
রসায়ন কিভাবে আমাদের জীবনের সাথে জড়িত এর অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে প্রসাধনের সামগ্রী এবং রূপচর্চার উপাদান। আমাদের মাথায় ব্যবহার করা শ্যাম্পু, মুখে লাগানো ক্রিম, শরীরের ব্যবহার করা লোশন, পারফিউম, মেকআপ, চুল রং করার হেয়ার কালার, সকলই তৈরি করা হয় কেমিক্যাল থেকে। এই উপাদানসমূহ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের একটি অংশ।
এছাড়াও রসায়নের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে
১। বিভিন্ন ফিল্টারের (Filter) পানি বিশুদ্ধ করতে ব্যবহার করা ক্লোরিন, অ্যাক্টিভেটেড চারকোল, অ্যালাম বা পটাশিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেটও কেমিক্যাল উপাদান।
২। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রে যে সকল কার্বনডাই-অক্সাইড, রাসায়নিক সেন্সর ব্যবহার করা হয় তাও কেমেস্ট্রির কল্যাণে হয়েছে।
৩। নির্মাণের (Building Industry) কাজে ব্যবহৃত সিমেন্ট, কংক্রিট, কাচ, ওয়াটার প্রুফ ইকুইপমেন্ট রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।
৪। আমাদের যেসকল কাগজী মুদ্রা (Money) ব্যবহার করে থাকি সেগুলোতে এক বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৫। মেয়েদের ব্যবহার যা গহনা যেমন সোনা (Gold), রুপার, ইত্যাদির বিশুদ্ধ করার জন্য নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়।
মিডিয়া কিংবা বিনোদন জগতে ব্যবহৃত ক্যামেরা, ফিল্ম, ডিসপ্লে, ব্যাটারি, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, আতশবাজি তৈরিতে পর্যন্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মোটকথা দৈনন্দিন জীবনের রসায়নের ব্যবহার অপরিসীম। বর্তমানে এটি শুধুমাত্র পরীক্ষাগারে কিংবা লেভেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি দিন দিন এর ব্যবহারও ক্ষেত্র গুলো আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হয়তোবা অদূর ভবিষ্যতে আমরা আরও নতুন নতুন বস্তু উপহার পাব এই রসায়নের কল্যাণে।
রসায়নের ব্যবহার সম্পর্কে সর্বশেষ আলোচনা
বিভিন্ন শিল্প এবং কলকারখানা থেকে ক্যামিকেলের ব্যবহারের কারণে এ থেকে এক ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এই বর্জ্য পদার্থগুলো যদি সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করা হয় তাহলে এগুলো সরাসরি উন্মুক্ত পরিবেশ যেমন নদী নালা, খাল বিল কিংবা ফসলের ক্ষেতে গিয়ে মিশ্রিত হয়। যার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হয়।
এছাড়াও কারখানা হতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, কাগজ, ইলেকট্রিক সার্কিট বোর্ড, এসিড, গ্রীন হাউজ গ্যাস, বিষাক্ত গ্যাস, ধোয়া, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি যদি সঠিক পদ্ধতিতে নিষ্কাশন না করা হয়ে থাকে তাহলে সেটিও মানুষের জন্য হুমকি শুরু।
যেগুলো পানির সাথে মিশে তৈরি করতে পারে নানা ধরনের রোগ এবং ক্ষতি করতে পারে ফসলের। এমনকি এর দ্বারা প্রভাবিত এলাকার জলজ উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার কলকারখানার কালো ধোঁয়া সাধারণ অক্সিজেনের সাথে মিশে মানুষের শ্বাসকষ্ট ও বক্ষব্যাধি রোগের তৈরি করতে পারে। আর এ সকল দূষণ শুধুমাত্র একটি এলাকার সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আমাদের দেশের শিল্প কারখানায় বিভিন্ন ধরনের রং, ক্রোমিয়াম, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। যেগুলো মাটির সাথে মিশে আস্তে আস্তে মাটি দূষণ বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে এ থেকে নানা ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। যা পুকুর ও নদী নালার মাছ এবং জলজ উদ্ভিদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কাজেই দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহারের গুরুত্ব জানার পাশাপাশি এর ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কেও জানা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যাতে করে আমরা নিজেরা এ সকল বিষয় থেকে সচেতন থাকতে পারি এবং পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারি।